সরাসরি প্রধান সামগ্রীতে চলে যান

ব্যাংকের শেয়ারের ফান্ডামেন্টাল এনালাইসিস

 ২০২১ সালের মাঝামাঝি থেকেই ঘুরে দাড়াতে পারে পুজিবাজারে বাংলাদেশের ব্যাংকিং সেক্টর।একটা দীর্ঘ সময় পর ২০২১ সালের আই পি ও তে আসতে পারে নতুন একাধিক ব্যাংক,তাই সামগ্রিক সেক্টর নিয়ে এখনি চিন্তা করার সময় চলে এসেছে।

আধুনিক যুগে যে কোন অর্থনীতির চালিকাশক্তি হচ্ছে সেদেশের ব্যাংকিং ব্যবস্থা। ব্যাংকের আর্থিক ভিত্তি যত শক্ত হয় অর্থনীতিও তার সাথে তাল মিলে এগোতে থাকে। বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের সাথে ব্যাংকেরও সংখ্যাবৃদ্ধি ঘটছে। সরকারী ও বেসরকারী খাতে অর্ধশতাধিক সিডিউলড ব্যাংক রয়েছে। তন্মধ্যে মোট ৩০টি ব্যাংক ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জে তালিকাভূক্ত। ডিএসই’তে তালিকাভূক্ত মোট কোম্পানীর শতকরা ৮ ভাগের মত ব্যাংক খাতের হলেও প্রতিটি ব্যাংকের পেইড আপ ক্যাপিটাল অন্য খাতের কোম্পানীর তুলনায় অনেক বেশী হওয়ার কারণে বাজার মূলধনের বড় অংশই ব্যাংক খাতের সাথে সম্পৃক্ত। তাইতো প্রতিদিনের বাজারচিত্রে দেখা যায় যে ব্যাংকিং খাতের শেয়ারের সামান্য মূল্য বৃদ্ধি বা মূল্য হ্রাসেই ডিএসইএক্স সূচক উল্লেখযোগ্যভাবে বাড়ে বা কমে। বর্তমানে ইন্সুরেন্স সেক্টরের অভাবনীয় মূল্য বৃদ্ধির পরও সে সেক্টরের স্বল্প পেইড আপ ক্যাপিটালজনিত কারণে দেখা যায় যে সার্বিক মূল্যসূচক তেমন বাড়ছে না কিংবা অন্য সেক্টরগুলোর, বিশেষত ব্যাংকিং সেক্টরে, সামান্য মূল্যহ্রাসের ফলে সূচক অনেকসময় কমে যায়। তাই বলা হয় যে ব্যাংকিং সেক্টর হচ্ছে ক্যাপিটাল মার্কেটের প্রাণ। সে কারণেই দেশের ক্যাপিটাল মার্কেটের উন্নয়ন করতে এ সেক্টরকে সবচেয়ে বেশী ভূমিকা রাখতে হবে। কিন্ত বর্তমানে তা হচ্ছে না। এ খাতের বেশীরভাগ ব্যাংকের শেয়ারদর পূর্বের বছরগুলোর তুলনায় প্রায় তলানীতে পড়ে আছে। দেশের ব্যাংকিং ব্যবস্থায় খেলাপী ঋণসহ নানা অনিয়ম থাকলেও এটি অনস্বীকার্য যে ব্যাংক খাতটি অর্থনীতির সবচেয়ে সুসংগঠিত খাত। সেখানে অন্তত কর্পোরেট কালচার এর প্রচলন রয়েছে। বিভিন্ন ব্যাংক মোটামুটি ভাল লভ্যাংশও প্রদান করে থাকে। সে কারণেই দেখেশুনে ব্যাংক খাতে বিনিয়োগ করতে পারলে সাধারন বিনিয়োগকারী শেয়ার মার্কেট থেকে সন্তোষজনক লাভ করতে পারেন।

সব ব্যাংক ব্যাংকিং সেবা প্রদান করলেও তাদের সবার সার্ভিসের ধরণ একরকম নয়। কিছু ব্যাংক  রিটেইল সেবার সাথে জড়িত, আবার কোন কোন ব্যাংক মূলতঃ কর্পোরেট ঋণ প্রদান করে। কিছু ব্যাংকের ফোকাস থাকে বহিঃবাণিজ্য, আবার কারো হয়তো কৃষি ঋণ। ব্যাংকগুলোর ফাইনান্সিয়াল পারফরমেন্সেও আছে ব্যাপক পার্থক্য। তাদের পণ্য বা সেবার ধরণ যেমন অনেকটাই ভিন্ন, তেমনি কোম্পানীগুলোর আর্থিক অবস্থান, কাষ্টমার বেইজ, প্রডাক্টস ও ম্যানেজমেন্ট কোয়ালিটি, তালিকাভূক্তির সময়, ইত্যাদিও ভিন্ন। তাই তাদের মধ্যকার নানা ভিন্নতার ফলশ্রুতিতে মার্কেটে তাদের শেয়ারদাম, ইপিএস, ডিভিডেন্ড হার, এবং শেয়ারের চাহিদায় রয়েছে ব্যাপক বৈষম্য। সে বৈষম্যের বড় প্রমাণ তাদের পি-ই রেশিও’তে যথেষ্ট ফারাক। উদাহরণ হিসাবে বলা যায় যে যেখানে এবি ব্যাংকের পি-ই রেশিও প্রায় ৬০, সেখানে প্রিমিয়ার ব্যাংকের পি-ই মাত্র ৩.০২ এবং ফাষ্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকের মাত্র ৩.৫৮। সে কারণেই বলা যৌক্তিক যে সার্বিকভাবে খাতটির আওতাধীন কোম্পানীসমূহের মৌল্ভিত্তির পার্থক্য থাকায় বিনিয়োগ ঝুঁকিও কোম্পানীভেদে ভিন্ন ভিন্ন। তাই বিনিয়োগের জন্য প্রযোজ্য সকল ক্রাইটেরিয়া পূরণ হলেই শুধুমাত্র সে ব্যাংকের শেয়ার ক্রয়ের বিষয়টি বিবেচ্না করা


উচিত হবে।

তালিকাভূক্ত ব্যাংক খাতে্র ৩০টি কোম্পানীর মধ্যে কোনটি বিনিয়োগযোগ্য বা যোগ্য নয় তা নির্ধারণে প্রয়োজন বিভিন্ন সূচক বা ইনডিকেটরের সাহায্যে কোম্পানীসমূহের পারস্পরিক তুলনা। এ খাতের ৩০টি কোম্পানীর মধ্য থেকে ১৪টি নির্বাচিত ব্যাংকের তুলনা দেওয়া হল

কোং পেইড আপ ক্যাপিটাল (কোটি টাকা) রিজার্ভ (কোটি টাকা) স্পন্সর শেয়ার হোল্ডিং (%) বিগত ৫ বছরে গড় ইপিএস (টাকা) বিগত ৫ বছরে গড় ডিভিঃ ইল্ড (%) রিটার্ণ অন ইক্যুইটি (%) রিটার্ণ অন এ্যাসেট (%) শেয়ারপ্রতি ফ্রি ক্যাশ ফ্লো (টাকা) খেলাপী ঋণ (%) এই সব বিষয়ের উপর ভিত্তি করে এখানে আলোচনা করা হবে।

 

ব্যাংকের নাম

ব্যাংক এশিয়া

ব্র্যাক ব্যাংক

ডাচ-বাংলা ব্যাংক

এক্সিম ব্যাংক

ফাষ্ট সিকিউঃ ইসলামী ব্যাংক

ইসলামী ব্যাংক

যমুনা ব্যাংক

এনসিসি ব্যাংক

ওয়ান ব্যাংক

প্রিমিয়ার ব্যাংক

পূবালী ব্যাংক

শাহজালাল ইসঃ ব্যাংক

ট্রাষ্ট ব্যাংক 

উত্তরা ব্যাংক

 

ব্যাংক খাতের এই ১৪টি কোম্পানির মধ্যে পারস্পরিক তুলনা করে দেখানো হবে।

 

পেইড আপ ক্যাপিটাল ও রিজার্ভের পরিমাণঃ

ব্যাংক গুলোর পেইড আপ ক্যাপিটাল ও রিজার্ভের পরিমাণ বেশী থাকলে কোন বছরে প্রত্যাশিত নীট আয় কম হলেও কোম্পানী রিজার্ভ থেকে ল্ভ্যাংশ দিতে সক্ষম হয়। এ অনুপাত যত বেশী হবে কোম্পানী ও শেয়ারহোল্ডারদের জন্য তা ততই ভাল। দেখা যাচ্ছে যে ব্যাংক খাতের টপ ১৪টি কোম্পানীর বেশীরভাগের রিজার্ভ তাদের পেইড আপ ক্যাপিটাল এর তুলনায় বেশ বেশী। শুধুমাত্র ৪টি ব্যাংক (ফাষ্ট সিকিউরিটি, ওয়ান, প্রিমিয়ার ও শাহজালাল ইসলামী) এর রিজার্ভ পজিটিভ হলেও তা পেইড আপ ক্যাপিটালের চেয়ে কম।

 

স্পন্সর শেয়ারহোল্ডিংঃ

স্পন্সর শেয়ারহোল্ডিং পজিশনের গুরুত্ব এজন্য যে একটি নির্দিষ্ট মাত্রার উপরে স্পন্সরদের পেইড আপ ক্যাপিটাল থাকলে ধরে নেয়া যায় যে তারা নিজের স্বার্থেই কোম্পানীকে লাভজনক করতে সর্বোচ্চ প্রচেষ্টা নিবেন। আর তাদের শেয়ার কম থাকা মানেই নিজের বিনিয়োগকৃত অর্থের পরিমাণ কম, যার ফলে তাঁদের ব্যক্তিগত ঝুঁকিও কম। সেক্ষেত্রে কোম্পানীর লাভের অংশও তাঁরা কম পাবে এবং যার ফলশ্রুতিতে কোম্পানীর উন্নয়নে সম্ভবত স্পন্সররা সর্বোচ্চ প্রচেষ্টা নিবেন না। এমনকি অসৎ কোম্পানী হলে ম্যানিপুলেশনের মাধ্যমে অতিরিক্ত খরচ দেখিয়ে কোম্পানীর লাভ কম প্রদর্শন করতে পারে। আইনগত এবং নৈতিক কারণে এটি কমপক্ষে ৩০ শতাংশ থাকা উচিত। ব্যাংক খাতে বর্ণিত ১৪টি কোম্পানীর মধ্যে ৪টি’র (ব্যাংক এশিয়া, ডাচ-বাংলা, ইসলামী ও ট্রাষ্ট ব্যাংক) স্পন্সর শেয়ারহোল্ডিং ৫০ শতাংশের উপরে রয়েছে যা সন্তোষজনক। তবে ৫টি ব্যাংকের (ফাষ্ট সিকিউরিটি, ওয়ান, প্রিমিয়ার, পূবালী ও উত্তরা) রয়েছে ন্যুনতম ৩০ শতাংশের কাছাকাছি শেয়ারহোল্ডিং। এ অনুপাত গ্রহণযোগ্য হলেও আরো বেশী স্পন্সর শেয়ারহোল্ডিং কাম্য ছিল।

 

৫ বছরের গড় ইপিএসঃ

 বিগত ৫ বছরের গড় ইপিএস কোম্পানীগুলোর সব খরচ শেষে শেয়ারপ্রতি নীট আয়ের অবস্থা প্রদর্শিত হয়েছে। এ সূচকটিও খুবই গুরুত্বপূর্ণ। একটি কোম্পানী কতটা লাভজনক এবং তার ব্যবসার প্রবৃদ্ধি কতটা হচ্ছে তা ইপিএস দেখে বুঝা যায়। তাছাড়া, ইপিএস বেশি না হলে প্রত্যাশিত হারে শেয়ারহোল্ডারদের ল্ভ্যাংশ দেয়ারও সুযোগ থাকে না। অন্য অনেক খাতের তুলনায় ব্যাংক খাতের সব কোম্পানীগুলোর ইপিএস পজিটিভ দেখা যায়, যদিও ব্যাংকভেদে তার পরিমাণ ভিন্ন ভিন্ন। সবচেয়ে বেশী ইপিএস রয়েছে ডাচ-বাংলা ব্যাংকের (১০.৬৫)। তারপর বেশী ইপিএস রয়েছে ব্র্যাক ব্যাংক (৪.২৫) ও উত্তরা ব্যাংকের (৪.০৩)। ৩ থেকে ৪ টাকার মধ্যে ইপিএস আছে ২টির (ট্রাষ্ট ও ইসলামী), আর ২ টাকা থেকে ৩ টাকার মধ্যে ইপিএস আছে মোট ৬টি ব্যাংকের (ব্যাংক এশিয়া, যমুনা, এনসিসি, ওয়ান, প্রিমিয়ার ও পূবালী)। সবচেয়ে কম ইপিএস (১ থেকে ২ টাকার মধ্যে) রয়েছে ৩টি ব্যাংকের (এক্সিম, ফাষ্ট সিকিউরিটি ও শাহজালাল ইসলামী)।

 

ডিভিডেন্ড ইল্ড :

ডিভিডেন্ড ইল্ড বছর শেষে শেয়ারহোল্ডাররা গড়ে যে পরিমাণ ল্ভ্যাংশ হাতে পাচ্ছে তা দেখায়। ফলে এ সূচকটিও খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কোন কোম্পানীর ইপিএস অনেক ভাল হলেও তার শেয়ার দাম বেশী হলে ইল্ড কমে যায়। আবার অনেক কোম্পানী ভাল লাভ হলেও লো পে আউট অর্থাৎ ডিভিডেন্ড কম ঘোষনা করতে পারে। অনেক কোম্পানী আবার ইপিএস কম হলেও রিজার্ভ থেকে নিয়ে ডিভিডেন্ড ঘোষনা করতে পারে। অনেক কোম্পানী আবার ক্যাশ ডিভিডেন্ডের সাথে সাথে স্টক ডিভিডেন্ডও দেয়। স্টক ডিভিডেন্ডকে ইল্ড বিবেচনায় নেয়া হয় না, কিন্ত তা্র ফলে শেয়ারহোল্ডার অতিরিক্ত শেয়ারের মালিক হন। কোম্পানীর  সার্বিক আর্থিক অবস্থান, ইপিএস, শেয়ার প্রাইস, ডিভিডেন্ড পলিসিসহ নানা ফ্যাক্টর দ্বারা ইল্ড প্রভাবিত হয়ে থাকে। তাই সেসব বিবেচনায় নিয়ে ডিভিডেন্ড ইল্ডকে দেখতে হবে। গত ৫ বছরের গড় ডিভিডেন্ড ইল্ড বিবেচনায় ব্যাংক খাতের কোম্পানীগুলো মোটামুটি আকর্ষণীয়। এখানে ২টি ব্যাংকের (এক্সিম ও যমুনা) ইল্ড ১০ শতাংশের উপরে; ১টি ব্যাংকের (এনসিসি) ইল্ড ৮ থেকে ১০ শতাংশের মধ্যে;  ৬টি ব্যাংকের (ব্যাংক এশিয়া, ফাষ্ট সিকিউরিটি, ওয়ান, প্রিমিয়ার, শাহজালাল ইসলামী ও উত্তরা) ইল্ড ৬ থেকে ৮ শতাংশের মধ্যে; ১টি ব্যাংকের (ইসলামী) ইল্ড ৪ থেকে ৬ শতাংশের মধ্যে এবং ৪টি ব্যাংকের (ব্র্যাক, ডাচ-বাংলা, পূবালী ও ট্রাষ্ট) ইল্ড ২ থেকে ৪ শতাংশের মধ্যে আছে। তাই বলা যায় যে ডিভিডেন্ড ইল্ড বিবেচনায় আকর্ষণীয় ব্যাংকগুলো হচ্ছে যমুনা, এক্সিম ও এনসিসি ব্যাংক।

 

রিটার্ন অন ইক্যুইটি (ROE)  :

 রিটার্ন অন ইক্যুইটি (ROE) বছর শেষে প্রতিটি শেয়ারের বিপরীতে যে পরিমাণ নীট আয় হচ্ছে তা দেখায়। কোম্পানী তার পেইড আপ ক্যাপিটাল, বিভিন্ন ধরনের প্রভিশন বাবদ রক্ষিত অর্থ, রিজার্ভ মানি এবং ব্যাংক ঋণ ব্যবহার করে যে আয় করে তা থেকে সব ধরনের খরচ ও ট্যাক্স বাদ দিয়ে নীট আয় হিসাব করা হয়। তাই এ অনুপাত কোন কোম্পানীর সম্পদ ব্যবহারের দক্ষতা ও পারদর্শিতাকে ইংগিত করে। একই খাতের আওতাধীন বিভিন্ন কোম্পানীতে সে অনুপাত ভিন্ন হলে তাদের দক্ষতা ও পারদর্শিতাও তদ্রপ বিবেচিত হয়ে থাকে। ROE যত বেশী হয় ততই শেয়ারহোল্ডারদের জন্য ভাল। এ অনুপাত অন্তত ১০ শতাংশ বা তার উপরে না থাকলে সেখানে বিনিয়োগ করা উচিত নয়। কারণ, এফডিআর এর মত নিরাপদ বিনিয়োগে যেখানে ৬% বা তার বেশী লাভ পাওয়া যায় সেখানে ঝুঁকি বিবেচনায় নিয়ে যে কোন শেয়ারের ROE অন্ততপক্ষে ১০% হওয়া যৌক্তিক। দেখা যাচ্ছে যে ব্যাংক খাতের নির্বাচিত কোম্পানীগুলোর মধ্যে ৫টির (ডাচ-বাংলা, যমুনা, ফাষ্ট সিকিউরিটি, প্রিমিয়ার ও ট্রাষ্ট) এর ROE  ১২% এর উপরে; আর ১০ থেকে ১২% ROE  আছে এমন ব্যাংক ১৪টির মধ্যে ৪টি (ব্র্যাক, এনসিসি, শাহজালাল ইসলামী ও উত্তরা)। বাকী ৩টি ব্যাংকের (এক্সিম, ইসলামী ও ওয়ান) ROE  ৮ থেকে ১০ শতাংশের মধ্যে। আর ২টির (ব্যাংক এশিয়া ও পূবালী) শেয়ারপ্রতি ROE ৭% এর নীচে, যা সন্তোষজনক নয়।

 

রিটার্ন অন এ্যাসেটস (ROA) :

 রিটার্ন অন এ্যাসেটস (ROA) একটি কোম্পানী তার মোট সম্পদ বা এ্যাসেট ব্যবহারের মাধ্যমে বছর শেষে কি হারে নীট মুনাফা অর্জনে সক্ষম হচ্ছে তা দেখায়। এটি কোম্পানীর সার্বিক দক্ষতা বা উৎপাদনশীলতার নির্ণায়ক। কোম্পানী তার পেইড আপ ক্যাপিটালের বাইরেও ঋণ গ্রহণের মাধ্যমে অতিরিক্ত এ্যাসেট ব্যবসায় খাটাতে পারে। ইক্যুইটি, ঋণ বা অন্য কোনভাবে কোম্পানীর হেফাজতে থাকা সম্পদ কতটা সফলতার সাথে কাজে লাগায় তা দেখা যায় ROA এর হার থেকে। এ হার যত বেশী হয় ততই ভাল। এক খাতের ROA এর সাথে অন্য খাতের ROA হার সাধারনভাবে ভিন্ন হয়ে থাকে। ব্যাংকিং সেক্টরে প্রয়োজনীয় মূলধনের পরিমাণ অত্যধিক বেশী এবং সে কারণে ROA অন্য খাতের চেয়ে কম হয়ে থাকে। তাই অন্য খাতের কোম্পানীর ROA হার না দেখে এক ব্যাংকের সাথে অন্য ব্যাংকের ROA তুলনা করাই শ্রেয়। আলোচ্য নিবন্ধে নির্বাচিত ১৪টি ব্যাংকের মধ্যে ৪টির (ব্র্যাক, ডাচ-বাংলা, যমুনা ও, প্রিমিয়ার) ROA ১% এর উপরে; আর ০.৫ থেকে ১% ROA আছে এমন ব্যাংক ৭টি (ব্যাংক এশিয়া, এক্সিম, এনসিসি, ওয়া্‌ন, শাহজালাল ইসলামী, ট্রাষ্ট ও উত্তরা)। বাকী ৪টি ব্যাংকের (ফাষ্ট সিকিউরিটি, ইসলামী ও পূবালী) ROA ০.৫% এর নীচে, যা সন্তোষজনক নয়।

 

 

ক্যাশ ফ্লো  FCF :

 শেয়ারপ্রতি ফ্রি ক্যাশ ফ্লো  FCF হচ্ছে কোম্পানী ভ্যালুয়েশন করতে খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি সূচক। এটি কোন কোম্পানীর আর্থিক স্বচ্ছলতা ও গতিশীলতার সত্যিকার নির্ণায়ক এবং তা যত বেশী হবে ততই ভাল। FCF’ই হচ্ছে শেয়ারহোল্ডারদের জন্য বিতরণযোগ্য প্রকৃত আয় যা দিয়ে ম্যানেজমেন্ট ডিভিডেন্ড ঘোষনা করতে পারে, কিংবা ব্যাংক ঋণ পরিশোধ করতে পারে। ফ্রি ক্যাশ ফ্লো’র পরিমাণ দিয়ে বুঝা যায় কোম্পানীর বিল্ডিং এবং প্লান্ট ইক্যুইপমেন্ট ঠিক রাখতে প্রয়োজনীয় রক্ষ্নাবেক্ষণ খরচ বাদ দেয়ার পর কি পরিমাণ ক্যাশ অবশিষ্ট থাকছে। ক্যাশকে কিং বা রাজা বলা হয়ে থাকে। কোম্পানীর আর্থিক প্রতিবেদনের Cash Flow Statement এর  ১ম  অংশের শেষাংশ অর্থাৎ Net Cash from Operating Activities এর পরিমাণ থেকে Cash Flow from Investments অংশে বর্ণিত প্লান্ট, ইক্যুইপমেন্ট এন্ড এষ্টাব্লিসমেন্ট (PPE) বাবদ ব্যয় বাদ দিলে যা থাকে তাই হচ্ছে মোট FCF। তারপর সে পরিমাণকে শেয়ার সংখ্যা দিয়ে ভাগ করলে শেয়ারপ্রতি FCF পাওয়া যায়। নির্বাচিত ১৪টি ব্যাংকের মধ্যে শেয়ারপ্রতি সবচেয়ে বেশী FCF রয়েছে ট্রাষ্ট ব্যাংকের, তারপরে ব্যাংক এশিয়া  ও ব্র্যাক ব্যাংকের । পূবালী ও উত্তরা ব্যাংকদ্বয়ের শেয়ারপ্রতি FCF ঋণাত্বক যা নগদ ক্যাশের দিক থেকে তাদের আর্থিক দূর্বলতা প্রদর্শন করে। ।

 

খেলাপি ঋণের শতকরা হার :

খেলাপী ঋণের শতকরা হার যা ব্যাংকিং সেক্টরের জন্য অতিশয় গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাতের সুস্থ বিকাশে সবচেয়ে বড় প্রতিবন্ধকতা হচ্ছে খেলাপী ঋণের উচ্চ হার। বাংলাদেশ ব্যাংকের এক হিসাব মতে, সেপ্টেম্বর ২০২০ শেষে ব্যাংকগুলোর মোট খেলাপী ঋণ দাড়িয়েছে ১ লাখ ১৬ হাজার ২৮৮ কোটি টাকা, যা মোট ঋণের প্রায় ১১.৯৯%। এরুপ উচ্চ খেলাপী ঋণহার ব্যাংকগুলোর মুনাফার বড় অংশই খেয়ে ফেলছে এবং যে কারণে ব্যাংকগুলো আগের মত ল্ভ্যাংশ ঘোষনা করতে ব্যর্থ হচ্ছে। ব্যাংকের শেয়ারদাম তলানিতে পড়ে থাকার সেটাই প্রধান কারণ। উল্লেখ্য, অনেক ব্যাংকই খেলাপী ঋণের হার নিজেদের বার্ষিক প্রতিবেদনে সরাসরি উল্লখ করে না। সেক্ষেত্রে একাউন্টস অংশে বর্ণিত ক্লাসিফাইড ঋণ ও মোট ঋণের তথ্য থেকে খেলাপী ঋণের হার বের করে নিতে হয়। বাংলাদেশে সিডিউলড ব্যাংকগুলোর খেলাপী ঋণের গড় হার প্রায় ১১.৯৯%। অবশ্য বেশিরভাগ বেসরকারী ব্যাংকের খেলাপী হার ততবেশী নয় এবং সরকারী খাতের ব্যাংকগুলোর মাত্রাতিরিক্ত হারের ফলেই গড় হার বেড়েছে। বিবেচনাধীন ১৪টি ব্যাংকের সবগুলোরই খেলাপী ঋণের হার জাতীয় হার থেকে কম। তবে তা যদি ৪% এর নীচে থাকে তবে তা অত্যন্ত ভাল। ১৪টি ব্যাংকের মধ্যে ৩টির (ব্র্যাক, ইসলামী ও যমুনা) খেলাপী ঋণহার ৪ শতাংশের নীচে রয়েছে। তবে ওয়ান ব্যাংক, উত্তরা ব্যাংক ও প্রিমিয়ার ব্যাংকের হার তুলনামূলকভাবে বেশী, যা আগামী দিনে ব্যাংকগুলোর মুনাফা কমিয়ে দিতে পারে।

 

উপরে বিভিন্ন সূচক বা ইন্ডিকেটরের সাহায্যে ব্যাংক খাতের যে ১৪টি কোম্পানীর মধ্যে পারস্পরিক তুলনা করা হলো তাতে দেখা যায় যে কোন কোম্পানিই সব সূচকে সর্বোত্তম অবস্থানে নেই। কোন ব্যাংক কিছু সূচকে ভাল অবস্থানে থাকলেও অন্য সূচকে খারাপ অবস্থানে রয়েছে। কেউ যদি দীর্ঘমেয়াদে শেয়ার ধরে রেখে ভাল ডিভিডেন্ড প্রত্যাশা করেন তবে তার জন্য যমুনা, এনসিসি ও এক্সিম ব্যাংক সঠিক চয়েস হতে পারে। সে ব্যাংকগুলোর সব কয়টি যৌক্তিক দামের মধ্যে রয়েছে। ব্র্যাক ব্যাংকের মৌল্ভিত্তি বেশ ভাল এবং এ ব্যাংকটির প্রতি বিদেশী বিনিয়োগকারীদের আগ্রহ বেশী থাকে। তাই ক্যাপিটাল এপ্রিসিয়েশন বিবেচনা করলে ব্যাংকটি অনেক সম্ভাবনাময়। অন্য কথায় ব্র্যাক ব্যাংকে মূলধনী লাভের সুযোগ ও ঝুঁকি উভয়ই বেশী। উত্তরা ব্যাংকের ফ্রি ক্যাশ ফ্লো তেমন ভাল না হলেও ইপিএস বেশী। তাছাড়া অন্যান্য ব্যাংকের তুলনায় উত্তরা ব্যাংকের পেইড আপ ক্যাপিটাল যথেষ্ট কম বিধায় তার দাম বাড়ার সুযোগ বাংলাদেশের মার্কেট বাস্তবতায় বেশী ধরা হয়। ফাষ্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকের মৌল্ভিত্তি মোটামুটি আছে। ব্যাংকটির ইপিএস কম থাকার কারণে শেয়ারদাম যথেষ্ট কম। তবে লক্ষ্য করার মত বিষয় হলো যে বেশ কয়েক বছর ধরেই ব্যাংকটির ব্যবসা তথা আমানত, বিনিয়োগের পরিমাণ এবং ইপিএস ধীরে হলেও ক্রমাগতভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে, যা অধিকাংশ ব্যাংকের বেলায় সত্য নহে। ডাচ-বাংলা ও ট্রাষ্ট ব্যাংকের মৌল্ভিত্তি দৃঢ় হলেও খেলাপী ঋণহার ও শেয়ার দামের বিবেচনায় তা তেমন আকর্ষণীয় নহে।

পরিশেষে বলতে হয় যে শেয়ার মার্কেটে বিনিয়োগ খুবই ঝুঁকিপূর্ণ। তাই কোন ব্যাংকের শেয়ার কিনবেন তা বিনিয়োগকারী তার নিজ পছন্দ ও অবস্থানের আলোকে ঠিক করতে পারেন। এ মার্কেটে টিকে থাকতে হলে যথাযথভাবে যাচাই বাছাই এর বিকল্প নাই। যথার্থ গবেষনা করার পর বিভিন্ন ক্রাইটেরিয়া বা সূচকের ভিত্তিতে কোন ব্যাংকের শেয়ার ক্রয় যৌক্তিক বা ফিজিবল হলেই শুধুমাত্র সেখানে বিনিয়োগের চিন্তা করা উচিত হবে।


সতর্কতাঃ বিভিন্ন সূচকের ভিত্তিতে বর্ণিত কোম্পানীগুলোর পারস্পরিক তুলনায় পাবলিক ড্যাটা ব্যবহার করা হয়েছে। আর প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে ব্যাংকগুলো সম্পর্কে যেসব মন্তব্য করা হয়েছে তা একান্তই লেখকের নিজস্ব মতামত যার সাথে বাস্তবের মিল নাও থাকতে পারে। তাই সেসব মন্তব্যের ভিত্তিতে কোন কোম্পানীর শেয়ার ক্রয় বা বিক্রয় থেকে বিরত থাকার জন্য সবাইকে পরামর্শ দেয়া হচ্ছে। অন্যথায় কারো ব্যক্তিগত আর্থিক ক্ষতির জন্য কোনক্রমেই লেখক দায়ী থাকবে না।


মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

ভাল কোম্পানি কত পার্সেন্ট ডিভিডেন্ড দিলে লাভ হবে?

লং ট্রাম বিনিয়োগকারীরা ভাল শেয়ার চেনার জন্য, কোম্পানীর ডেভিডেন্ড ইল্ড দেখে থাকেন।যে সমস্ত শেয়ারের  ডেভিডেন্ড ইল্ড ভাল সেই সব শেয়ার লং ট্রাম বিনিয়োগকারীদের জন্য বেশি আকর্ষণীয় হয়ে থাকে।তাই আজকে আমরা  ডেভিডেন্ড   কি ? এবং  কত টাকায় কত পার্সেন্ট ডেভিডেন্ড দিলে ভাল হবে ,অর্থ্যাথ  ডেভিডেন্ড ইল্ড বাহির করার মাধ্যমে কি ভাবে ভাল শেয়ার চিনা যায়, তাই নিয়ে আলোচনা করব। ডিভিডেন্ড ( Dividend ) অর্থ লভ্যাংশ। একটি কোম্পানির তার মুনাফার যে অংশ শেয়ারহোল্ডারদের মধ্যে বিতরণ করে থাকে তা-ই লভ্যাংশ বা ডিভিডেন্ড। কখনো কখনো রিজার্ভ বা সংরক্ষিত তহবিল থেকেও লভ্যাংশ বিতরণ করা হয়। লভ্যাংশ নগদ টাকা বা স্টক (শেয়ার) অথবা উভয় আকারে হতে পারে। লভ্যাংশ সাধারণত শতাংশের হিসাবে প্রকাশ করা হয়। ডিভিডেন্ড সব সময় প্রদান করা হয় ফেস ভ্যালুর উপর ভিত্তি করে। যেমন ১০% ডিভিডেন্ড দিলে প্রতি শেয়ারে ডিভিডেন্ড হবে ১ টাকা। কারন ফেস ভ্যালু ১০ টাকা এবং ১০ টাকার ১০% হচ্ছে ১ টাকা। যদিও শেয়ারের ফেস ভ্যালু ১০ টাকা কিন্তু মার্কেটে শেয়ারের দাম ১০ টাকার থেকে বেশি বা কম হতে পারে। ধরা যাক ১০% হারে ডিভিডেন্ড দেওয়া কোম্পানি...

ক্যান্ডেলষ্টিক এর উৎপত্তির ঘটনা ও এর পিছনের সাইকোলজি

   মুনিসিহা হোমা [Munehisa Homma] ইতিহাসের সবচেয়ে সফল প্রাইজ একশন ট্রেডার।লোক্মুখে প্রচলিত আছে ,তিনি ট্রেডিংএর মাধ্যমে  ১০ বিলিয়ন ডলার আয় করেছিলেন। এখন মনে প্রশ্ন আসতেই পারে কে এই  মুনিসিহা হোমা [Munehisa Homma]? তিনি জাপানের সাকাতা ইয়ামাগাতার একজন কৃষক,একজন কৃষক তার ধানের বাজার দর ওঠা নামা ধরার জন্য ক্যান্ডলষ্টিক আবিষ্কার করে। টেকনিক্যাল এনালাইসিসের তিনি পথদ্রষ্টা। আজকের এই আর্টিকেল এই ক্যান্ডালষ্টিক এবং ক্যান্ডেলষ্টিক এর সাইকোলজি নিয়ে আলোচনা করা হবে। যাদের ষ্টোক মার্কেট নিয়ে আগ্রহ আছে তারা সবাই কম বেশি ক্যান্ডেলষ্টিক নিয়ে ধারণা রাখে। তাই আমরা একটু ভিন্ন ভাবে শুরু করব ,প্রথমে চিন্তা করব কি প্রেক্ষাপটে এবং কি সমস্যায় ক্যান্ডেলষ্টিক আবিষ্কার করতে হয়ে ছিল। কি তার সাইকোলজি এবং এর রহস্য ,ভেদ করা হবে এখানে। আজ থেকে প্রায় ৪০০ বছর আগে ধরি ,মুনিসিহা তার ধান বিক্রি করার জন্য রওনা হল এখন যেহেতু ৪০০ বছর আগের ঘটনা তাই কোন যান্ত্রিক যানবাহন আশা করা যায় না,ধরলাম গাধার পিঠে করে ধানের বস্তা নিয়ে যাচ্ছে। যেহেতু গাধার পিঠে ধানের বস্তা নিয়ে যাচ্ছে তাই সঠিক সময়ে গন্তব্যে আসা সম্ভব হ...

ক্যান্ডেলষ্টিক কিভাবে কাজ করে ?

আমরা অনলাইনে চ্যাট করার সময় কম বেশি সকলেই ইমোজি ব্যবহার করে থাকি ,এই সব ইমোজি কোন ভাষা নয়, কিন্তু তার পর ও প্রতিটি ইমোজির ভিন্ন ভিন্ন  অর্থ আছে। ঠিক তেমনি ভাবে ক্যান্ডেলষ্টিক আপাত দৃষ্টিতে দেখতে সরলরেখা আকৃতির চিহ্ন হয়ে থাকলে, এই গুলো ঠিক ইমোজির মত অর্থ পূর্ণ সংকেত প্রদান করে থাকে। ক্যান্ডেলষ্টিক হচ্ছে মার্কেটের স্মাইলি, মার্কেট যদি আপনার সাথে সম্পর্ক স্থাপন করতে চায় ,তাহলে তা ক্যান্ডেলষ্টিক এর মাধ্যমেই তা  করা সম্ভব হবে।  উদাহরণ হিসাবে বলা যায় ,ধরুন আপনি আপনার বন্ধুর কাছে  চ্যাটে এক হাজার টাকা ধার চাইলেন, উত্তরে আপনার বন্ধু 👍😀 এই ইমো দিয়ে পাঠাল তাহলে আপনি পজেটিভ হিসাবে ধরে নিবেন।ঠিক একই ক্ষেত্রে যদি 👿 এই ইমো দিত তাহলে বুঝতেন কোন না কোন ঝামেলা আছে। বন্ধু টাকা দিতে রাজি না।  ঠিক এই রকমই ক্যান্ডেলষ্টিক ও পজেটিভ হয়ে থাকে আবার আনুরূপ ভাবে নেগেটিভও হয়ে থাকে, যে ভাবে আমরা ইমো দেখে আমরা মানুষের অনুভূতি বুঝতে পারি ,ঠিক তেমনি আমরা যদি আমাদের চোখকে ঠিকমত ট্রেইন করতে পারি তাহলে আমরা ক্যান্ডেলষ্টিক দেখেও মার্কেট কেমন হবে অনুধাবন করতে পারব। ক্যান্ডেলষ্টিক আপনাকে বিহাইন্ড ...